তাপস কুমার: ঐ-যে সমস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালবাসি-ওর এই গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তদ্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দু’হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এসব কি কোন স্বর্গ থেকে পেতুম? স্বর্গ আর কী দিত জানি নে, কিন্তু এমন কোমলতা দুর্বলতাময়, এমন সকরুণ আশংকাভরা, অপরিণত এই মানুষগুলির মতো এমন আদরের ধন কোথা থেকে দিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯১ সালের জানুয়ারী মাসে কালীগ্রাম (কালীগ্রাম পরগণার সদর পতিসর) থেকে ইন্দিরা দেবীকে এ চিঠিটি লেখেন। এ চিঠির কথাগুলোতে পতিসরের মাটি ও মানুষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের গভীর ভালবাসা ও মমত্ব ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে পতিসরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও রবীন্দ্রনাথকে বিমোহিত করেছে।
রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগণার এই জমিদারি কেনেন ১৯৩০ সালে। কালীগ্রাম পরগণার সদর দপ্তর ছিল পতিসর। পতিসর নওগাঁর আত্রাই উপজেলার একটি গ্রামের নাম। আত্রাই উপজেলা সদর থেকে পূর্বদিকে ১৪ কিলোমিটার দূরে দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। নাগর নদের তীরের এই পতিসরেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কাচারীবাড়ি।
জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের তত্কালীন পূর্ববঙ্গে তিনটি জমিদারি ছিল। নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার বিরাহিমপুর (সদর শিলাইদহ) পরগণা, পাবনা জেলার সাজাদপুর পরগণা (সদর সাজাদপুর) এবং রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগণা (সদর পতিসর)। কবি ও জমিদার রবীন্দ্রনাথ কখনো শিলাইদহ থেকে, কখনো সাজাদপুর থেকে, কখনো আত্রাই ঘাট রেল স্টেশন থেকে নিজস্ব বজরায় পদ্মা, করতোয়া, বড়াল, আত্রাই, নাগর এবং চলনবিল পেরিয়ে জমিদারি তদারকের জন্য পতিসর আসতেন।
ড. শচীনন্দন ঘোষালের ‘পল্লী উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রস্থ থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ জমিদারির প্রকৃত ভার পেয়েছিলেন ১৮৯৬ সালের আগষ্ট মাসে। দেবেন্দ্রনাথ ‘পাওয়ার অব অ্যাটনি’ করে সমস্ত সম্পত্তির সব কর্তৃত্ব তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ১৮৯০ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ কে জমিদারির শিক্ষানবিশ করে কাটাতে হয়েছে। জমিদারির জটিল দায়-দায়িত্বের বিরাট বোঝা বহনের দক্ষতার পরীক্ষা দিয়ে হয়েছে পিতা দেবেন্দ্রনাথের কাছে।
ঠাকুরপরিবারের জমিদারি ভাগাভাগি হয় ১৯২০ সালে। রবীন্দ্র-গবেষক ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী রচিত ‘পতিসরে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রস্থ থেকে জানা যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একান্নবর্তী পরিবারের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিজেই সম্পন্ন করে দেন। পাবনার সাজাদপুর পরগনা অনুজ গিরীন্দ্রনাথের ভাগে এবং নদীয়ার বিরাহিমপুর ও রাজশাহীর কালীগ্রাম পড়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের ভাগে। পরবর্তীকালে জমিদারি আবার ভাগ হয়। শিলাইদহসহ বিরাহিমপুর পরগণা যায়, সত্যেন্দ্রনাথের পুত্র সুবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অংশে, রবীন্দ্রনাথের থাকে শুধু কালীগ্রাম পরগণা। শিলাইদহও পরে ঋণের দায়ে চলে যায় ভাগ্যকুলের কুন্ডুদের হাতে। ১৯২১ সালে জমিদারি পুরোপুরি ভাগ-বাঁটোয়ারর পর শুধু কালীগ্রাম পরগণার জমিদারি তদারকের কাজে বরীন্দ্রনাথকে বহুবার পতিসর আসতে হয়েছে।
কালীগ্রাম পরগণা তথা পতিসর কাচারিবাড়ি রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব জমিদারি। সে জন্য পতিসর এলাকার মানুষের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রাণের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পতিসরই হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন ও পরিকল্পনার প্রাণকেন্দ্র। এখানে প্রজাদের কল্যাণে অনেক জনহতিকর কাজ করেন তিনি। যেমন- পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন, রেশম চাষ, সমবায় পদ্ধতি, বিচার ব্যবস্থা, পুকুর-দিঘি খনন, চাষাবাদের জন্য কালের লাঙলের প্রচলন, তাঁতে কাপড় বোনা, গ্রাম্য শিল্প প্রচলন, মাছের ব্যবসা, দুর্ভিক্ষের জন্য ধর্মগোলা স্থাপন ইত্যাদি।
শিলাইদহ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক না থাকার কারণে রবীন্দ্রনাথ সেখানে মন মতো সংস্কারমূলক কাজ করতে পারেননি। কিন্তু পতিসর এলাকায় এ ধরনের সমস্যা ছিল না। সে জন্য তিনি পতিসরকেই বেছে নিয়েছিলেন বিভিন্ন উন্নয়নমূলক সংস্কার কাজের ক্ষেত্র হিসেবে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃ স্মৃতি’ গ্রন্থে বলেছেন, শিলাইদহের চার পাশে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সদভাব নেই। নতুন কিছু প্রর্বতন করতে গেলেই সন্দেহ করে। কয়েক বছর চেষ্টা করেও সেখানে বিশেষ কিছু করতে পারা যায়নি। এই কারণে কালীগ্রাম পরগনাতেই তিনি বেশী মনোযোগ দিয়েছিলেন। সেখানকার প্রজাদের মধ্যে একনিষ্ঠতা ছিল।
কালীগ্রাম পরগণায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও সংস্কার কাজের জন্য প্রজাদের নিয়ে ‘কালীগ্রাম হিতৈষী সভা’ গঠন করা হয়। পাঁচজন ছাড়াও কেন্দ্রীয় হিতৈষী সভায় জমিদারের একজন প্রতিনিধি থাকে। কাজের সুবিধার জন্য সমগ্র পরগণাকে তিন ভাগে ভাগ করে তিনটি ‘বিভাগীয় হিতৈষী সভা’ গঠন করা হয়। প্রজাদের খাজনার প্রতি টাকার সঙ্গে তিন পয়সা অতিরিক্ত আদায় করে হিতৈষী সভার তহবিল গঠন করা হয়। প্রজারা স্বেচ্ছায় চাঁদা দিয়ে এই তহবিল গঠন করত। হিতৈষী সভা প্রথমে শিক্ষাব্যবস্থার কাজে হাত দেয়। হিতৈষী সভা কয়েকটি গ্রামে পাঠশালা, তিনটি মধ্যমিক ইংরেজী স্কুল ও পতিসরে একটি হাইস্কুল স্থাপন করে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃ স্মৃতি’ গ্রস্থে বলেন, সারা পরগণার মধ্যে শিক্ষার কোন ব্যবস্থাই পূর্বে ছিল না। অবস্থাপন্ন লোক তাদের ছেলেদের নাটোর, আত্রাই, বগুড়াসহ বিভিন্ন শহরে পাঠাতো স্কুলে পড়াবার জন্য। পতিসরে কৃষির উন্নতি করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। কারণ পতিসর অঞ্চলটা এক-ফসলে। অঞ্চলটা নিচু হওয়ায় বছরের বেশির ভাগ সময় ফসলের মাঠ পানির নিচে থাকে। শুস্ক মৌসুমেও মাটি কঠিন হয়ে থাকে, লাঙল চলে না। রথীন্দ্রনাথ তাঁর গ্রস্থে বলেন, ‘শিলাইদহ অঞ্চলে কৃষির উন্নতি করার যথেষ্ঠ সুযোগ পেলুম। কিন্তু পতিসরে সে সুযোগ নেই, অঞ্চলটা নিতান্তই এক ফসলে। বর্ষার কয়েকমাস জলমগ্ন থাকে আর জল নেমে গেলে মাটি শুকিয়ে এত কঠিন হয়ে যায় যে লাঙ্গল চলে না। সেই জন্য রবিশষ্য কিছুই হয় না। এমনকি, গাছপালাও জন্মায় না। বাবা কিন্তু এই অসুবিধা সত্বেও কালীগ্রামে আবাদের কী উন্নতি হতে পারে তাই নিয়ে চিন্তা করতে ছাড়েন নি। ১৩১৫ সালে তিনি কোন এক কর্মীকে লিখছেন, প্রজাদের বস্তুবাড়ী ক্ষেত্রের আইল প্রভৃতি স্থানে আনারস, কলা, খেজুর প্রভৃতি ফলের গাছ লাগাইবার জন্য তাহাদিগকে উত্সাহ করিও। আনারসের পাতা হইতে খুব মজবুত সুতা বাহির হয়। ফলও বিক্রয়যোগ্য শিমুল আঙ্গুর গাছ বেড়া প্রভৃতির কাজে লাগাইয়া তাহার মূল হইতে কিরুপ খাদ্য বাহির করা যাইতে পারে তাহাও প্রজাদিগতে শিখানো আবশ্যক। আলুর চাষ প্রচলিত করিতে পারিলে বিশেষ লাভ হাইবে। কাচারিতে যে আমেরিকান ভুট্টার বীজ আছে তাহা পুনর্বার লাগাইবার চেষ্টা করিতে হইবে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পিতৃ স্মৃতি’ গ্রস্থে লিখেছেন, ‘অনেক চেষ্টার ফলেও কালীগ্রামে চাষাবাসের বিশেষ উন্নতি করা সম্ভব হয়নি। কয়েক বছর পর একটা সুযোগ পেলুম। উত্তরবঙ্গ বন্যার সাহায্যার্থে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় মহাশয় অনেক টাকা তুলেছিলেন। দুঃস্থদের সাহায্য করার কাজ শেষ হয়ে গেলে এই ফান্ডে কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থেকে গিয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে আত্রাইতে স্থায়ী ভাবে একটি খাদি আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন, কয়েকটি ট্রাক্টরও কেনা হয়। ট্রাক্টর কেনার উদ্দেশ্য ছিল, বন্যাতে অনেক গরু মরে যাওয়ায় লাঙ্গল চালাবার উপায় ছিল না, আচার্যদেবের কাছ থেকে পতিসরের জন্য একটা লাঙ্গল চেয়ে নিলুম। আমাদের দেশে তখনও ট্রাক্টরের চলন হয়নি। ট্রাক্টর তো পেলুম কিন্তু চালক পেলুম না। নিজেই চালাতে লাগলুম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে কুটিরশিল্প বিস্তারে পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলেন। একজন মুসলমান জোলাকে শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয়েছিল প্রশিক্ষণের জন্য। কুটিরশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ শেষে ওই জোলাকে পতিসর নিয়ে এসে তাকে শিক্ষক করে একটি বয়ন শিক্ষার স্কুল খোলা হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র এবং পতিসরের শেষ জমিদার রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘বোলপুরে একটা ধানভানা কল চলছে…..সেইরকম একটা কল এখানে (পতিসর) আনাতে পারলে বিশেষ কাজে লাগবে। এ দেশ ধানেরই দেশ বোলপুরের চেয়ে অনেক বেশী ধান এখানে জন্মায়। এই কলের সন্ধান দেখিস।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারের শুরুতেই পতিসরে সালিশি বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পরগণার কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি করে বিচারসভা স্থাপন করেন। নিয়ম করা হলো, প্রজাদের মধ্যে কোনো বিবাদ হলে উভয় পক্ষকেই বিচারসভায় উপস্থিত হতে হবে। প্রজারা ফৌজদারি ছাড়া অন্য কোনো রকম মামলা নিয়ে আদালতে যাবে না। কেউ এই নিয়ম অমান্য করলে গ্রামবাসী তাকে একঘরে করবে, তার সঙ্গে কেউ সম্পর্ক রাখবে না। বিচারে আপিলেরও ব্যবস্থা ছিল। সমস্ত পরগণার জন্য পাঁচজন সভ্য নিয়ে একটি আপিল বিভাগ ছিল। এই পাঁচজনকে পঞ্চপ্রধান বলা হতো। পঞ্চপ্রধানের বিচারে সন্তুষ্ট না হলে শেষ আপিল ছিল স্বয়ং জমিদারের কাছে। এ ধরনের বিচার ব্যবস্থা চালু হওয়ায় প্রজারা খুশি হয়েছিল এবং আদালতে নালিশ করতে যাওয়া তারা ছেড়ে দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘আদালতের সাহায্য ছাড়া বিনা ব্যয়ে বিনা বিলম্বে মামলার বিচারের এই ব্যবস্থা আরম্ভ হবার শুরু থেকেই প্রজারা এর উপকারিতা অনুভব করেছিল।’
জমিদার জীবনের শুরুতেই রথীন্দ্রনাথ লক্ষ করলেন, প্রজারা সকলেই ঋণী। গরিব প্রজারা মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তা শোধ করতে পারত না। কারণ সুদের হার ছিল অত্যন্ত বেশি। আর সুদের সুদ আদায় করা হতো। প্রজাদের এই দুঃখ-দুর্দশা দেখে প্রজাদরদি জমিদার রথীন্দ্রনাথের প্রাণ কেঁদে ওঠে। ধার করা টাকা দিয়ে তিনি পতিসরে একটি কৃষিব্যাংক স্থাপন করলেন। ‘পিতৃ স্মৃতি’ গ্রন্থে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেলেন, ‘হাজার টাকা ধার নিয়ে পতিসরে একটি কৃষি ব্যাংক খুলে বসলেন।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল পুরস্কারের এক লাখ আট হাজার টাকা পতিসর কৃষি ব্যাংকে ডিপোজিট হিসেবে রেখেছিলেন। প্রজারা কৃষিব্যাংক থেকে কর্জ নেওয়া শুরু করলে মহাজনরা তাদের কারবার গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
শুধু জমিদারি ও উন্নয়ন পরিকল্পনাই নয়, এই পতিসর ছিল রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সৃষ্টির অনন্ত প্রেরণা। এখানে তিনি রচনা করেছেন অনেক কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। এখানে তিনি রচনা করেন দুর্লভ জন্ম, মেঘদূত, আমাদের ছোট নদী, পল্লীগ্রাম, মধ্যাহ্ণ, সামান্য লোক, খেয়া, বন, তপোবন, অনন্তপথে, ক্ষণমিলন, প্রেম প্রভৃতি কবিতা। বিখ্যাত গান বিধি ডগার আঁখি, বধূ মিছে রাগ করো না, জলে-ডোবা চিকন শ্যামল, আমি কান পেতে রই, তুমি নবরুপে এসো প্রাণে প্রভৃতি। ছোট গল্প প্রতিহিংসা, ঠাকুরদা, কাদম্বরী। উপন্যাস ‘গোরা’ ও ‘ঘরে-বাইরে’র অংশ বিশেষ। এ ছাড়া বেশকিছু প্রবন্ধ, ছিন্ন পত্রাবলি এই পতিসরে রচিত। রবীন্দ্রনাথ গ্রাম উন্নয়নের যে ধারাকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন (রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘পল্লী সঞ্জীবন’ অর্থাৎ গ্রামের মধ্যে প্রাণের নবজাগরণ) তাকে আধুনিক অর্থবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘পল্লী উন্নয়ন’-এর সামগগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বা ‘সিষ্টেম অ্যাপ্রোচ’ হিসেবেই মানতে হয়। ঔপনিবেশিক শাসনকালে রবীন্দ্রনাথ যে কৃষি অর্থনীতির মৌলিক কার্যক্রমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা এক কথায় অভাবনীয়, কেননা তখনো ওই ঊনিবিংশ শতকের শেষ পাদে কোনো উন্নয়নতত্বের জন্মই হয়নি। কৃষি-অর্থনীতির উন্নয়ন তো দূর অস্ত, অর্থনৈতিক উন্নয়নতত্ব কথাটার জন্ম দিয়েছেন জার্মান অথরনিতীবিদ গ্যুমপিটার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে মাত্র। স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথ যে পদ্ধতিতে কৃষি তথা ভুমি-অর্থনীতির ব্যবহারিক দিক থেকে রায়ত-উৎপাদন-উপাদান ব্যবস্থার ভেতরে কৃষিফসল ফলানোর উন্নতির পথ অবলম্বন করে দেখিয়েছেন, তা অবশ্যই ‘রবীন্দ্র-কৃষি-উন্নয়ন মডেল’ বলেই স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। রবীন্দ্রনাথ পতিসরে গড়ে তুলতে চেয়েছিল তাঁর সাধের পল্লীসমাজ (স্বদেশি সমাজ), সচ্ছল শিক্ষিত স্বনির্ভর গ্রাম। আজ থেকে প্রায় একশ বিশ বছর আগে পতিসর ঘিরে এই ছিল রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর পতিসরের এই সব কর্মকান্ড থেমে যায়। এরপর জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। আস্তে আস্তে নিরব-নিথর হয়ে যায় একসময়ের প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপর পতিসর। কালের গর্ভে হারিয়ে যায় পতিসরের সেই সুবর্ণ দিন। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পতিসরের কাচারীবাড়ী। কাচারীবাড়ীটি দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থেকে জীর্ণ হয়ে যায়। লুটপাট ও চুরি হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যায় পতিসরের সেই সুবর্ণ দিন। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পতিসরের কাচারিবাড়ি। কাচারিবাড়িটি দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থেকে জীর্ণ হয়ে যায়। লুটপাট ও চুরি হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। ১৯১৪ সালে প্রত্নতত্ব বিভাগ কাচারীবাড়ি অধিগ্রহন করে। ২০০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত চুরি যাওয়া কিছু কিছু জিনিসপত্র উদ্ধার করে কাচারীবাড়িতে রাখা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে বাথটাব, বোটের নোঙর, কৃষিচাষের ট্রাক্টরের যন্ত্রাংশ, চেয়ার-টেবিল, কাঠের আলমারি, খাট, আরাম কেদারা, লোহার সিন্দুক এবং বেশ কিছু দুর্লভ ছবি।
রবীন্দ্রনাথ পতিসরের মাটি ও মানুষকে অত্যন্ত আপন মনে করে ভালবেসেছিলেন। পতিসর থেকে ১৮৯৪ সালের ২১ মার্চ তারিখে ইন্দিরা দেবীকে লেখা তাঁর একটি চিঠিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘এখানকার প্রজাদের উপর বাস্তবিক মনের স্নেহ উচ্ছ¡সিত হয়ে ওঠে-এদের কোন রকম কষ্ট দিতে আদবে উচ্ছে করে না। এদের সরল ছেলেমানুষের মতো অকৃত্রিম স্নেহের আবদার শুনলে বাস্তবিক মনটা আর্দ্র হয়ে ওঠে।
যখন তুমি বলতে বলতে তুই বলে ওঠে, যখন আমাকে ধমকায়, তখন ভারী মিষ্টি লাগে। এক এক সময় আমি ওদের কথা শুনে হাসি, তাই দেখে ওরাও হাসে।’
সূত্র: সময়ের কন্ঠস্বর
No comments:
Post a Comment