আমি তখন নারায়ণগঞ্জে তোলারাম কলেজের ছাত্র। ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে
পড়ছি। পড়াশোনায় ভালোই ছিলাম। পাশাপাশি মার্শাল আর্টস শিখছি, আধুনিক নাচ
শিখছি। নায়ক হওয়ার স্বপ্ন তখনো দেখিনি। এলাকায় থার্টি ফার্স্ট নাইটে কিংবা
কোনো অনুষ্ঠানে নাচ করি। তাতেই আমি মহাখুশি। মহল্লায় সবাই একটু আলাদা চোখে
দেখে। আমার নিজের মধ্যে তখন হিরো হিরো একটা ভাব!
আজিজ ভাই ছিলেন আমার
নাচের শিক্ষক। তিনি আবার চলচ্চিত্রে নৃত্য পরিচালনা করেন। তাঁর সঙ্গে একদিন
এফডিসিতে যাই। তিনি আমাকে আবুল খায়ের বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে
দেন। সেটা ছিল ১৯৯৮ সাল। বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে আমার কিছুক্ষণ কথা হয়। তিনি
আমাকে একটা ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন। সব মিলিয়ে সময় লাগবে তিন মাস।
তাতে পড়াশোনার তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু তার আগে আমার আব্বার সঙ্গে
তিনি আলোচনা করবেন। আব্বা রাজি হলে তবেই আমি ছবিতে সুযোগ পাব। আর এর জন্য
আব্বাকে নিয়ে যেতে হবে এফডিসিতে।
আব্বা-আম্মা দুজনই ছিলেন সরকারি
কর্মকর্তা। আব্বাকে কীভাবে বলব এই কথা! দুশ্চিন্তায় আমার তো রাতে ঘুম আসে
না। আমরা দুই ভাইবোন। আমিই বড়। আম্মার সঙ্গে আমার দারুণ ভাব। যত আবদার, সব
আম্মার কাছে। সাহস করে আম্মাকে পুরো ব্যাপারটি বললাম। আব্বাকে রাজি করানোর
দায়িত্ব নিলেন আম্মা।
আমাদের বাসায় শুরু হলো নতুন ঘটনা। আম্মা যতই
চাইছেন আমি ছবিতে অভিনয় করি, আব্বা ততই নিষেধ করছেন। কোনোভাবেই আব্বাকে
রাজি করানো যাচ্ছে না। আব্বার এক কথা, আগে পড়াশোনা শেষ করুক, তারপর দেখা
যাবে।
এদিকে দিন চলে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আম্মার চাপের কাছে নতি
স্বীকার করেন আব্বা। এফডিসিতে এসে কথা বলেন বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে। বুলবুল
ভাইয়ের ছবির কাজ তখন করা হয়নি। আমি প্রথম কাজ করেছি সোহানুর রহমান সোহানের
অনন্ত ভালোবাসা (১৯৯৯) ছবিতে। যেহেতু আমি মার্শাল আর্ট আর আধুনিক নাচ জানি,
তাই আরও কয়েকজন পরিচালক আমাকে কাজের প্রস্তাব দিলেন।
আমার তখন একটাই ভাবনা, কখন আমার ছবি মুক্তি পাবে
।
এদিকে আমার ছবি মুক্তির দিন চূড়ান্ত হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশের
প্রেক্ষাগৃহে আর সড়কের পাশে আমার ছবির পোস্টার। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন। পুরো
ব্যাপারটি আমাদের আত্মীয়স্বজন, আব্বা-আম্মার সহকর্মী, প্রতিবেশীদের কেউই
স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। আর এর জন্য আম্মাকেই বেশি কথা শুনতে হয়েছে।
ওই সময়টাতে আম্মা ছিলেন একেবারেই চুপ। তিনি আমাকে বিশ্বাস করতেন। আম্মার
বিশ্বাস ছিল, তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নেননি। আর আমিও তাঁর বিশ্বাসের অমর্যাদা
করব না।
যেদিন আমার প্রথম ছবি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল, আমার মনে আনন্দ
যেন ধরে না। চারদিক থেকে নানা কথা শুনছি। সবই আমার পক্ষে। তখন বারবার
আম্মার মুখটা আমার সামনে ভেসে ওঠে। ছবি দেখে তিনি কী বলবেন? বাসার সবাইকে
সঙ্গে নিয়ে গেলাম ছবিটা দেখতে। ছবি দেখে আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তিনি
খুব খুশি হয়েছিলেন। আব্বাকে বললেন, ‘দেখছ, ও কী সুন্দর ছবি করছে! ও আরও
ভালো করবে।’
এরপর অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করেছি। সবার ভালোবাসা পেয়েছি। ১৫
বছর পর এসে মনে হচ্ছে, আমার জন্য আম্মা কী যুদ্ধটাই না করেছেন। এখনো করছেন।
তবে এই যুদ্ধে আম্মা জয়ী হয়েছেন।
এখন আম্মার একটাই কথা, ‘বাবা, অনেক তো হলো, এবার ঘরে একটা বউ আন।’
জানি না, আম্মার এই স্বপ্নটা কবে পূরণ করতে পারব।
No comments:
Post a Comment